আসাদ আজিম:
নানা কু সংস্কার, অদ্ভুত রীতী রেওয়াজ, আর ধর্মীয় গোঁড়ামির মিশেল, সম্ভবত এই দক্ষিন এশীয় অন্ঞ্চল ছাড়া বর্তমান পৃথিবীর অন্য কোথাও মিলবে না৷ শিক্ষার প্রচার প্রসার যেখানে রুদ্ধ হয়েছে অলীক কৃষ্টি কালচার সেখানেই আগাছার মত গজিয়ে উঠেছে। চাই সে ইউরোপের ডাইনি নিধনের রুপেই হোক, কিংবা আরবের কন্যাসন্তান হত্যাই হোক। শিক্ষার প্রসারের পাশাপাশি রাজনৈতিক হস্তক্ষেপেই ক্রমে এসব কু সংস্কার থেকে রক্ষা পেয়েছে বিশ্ব। সতীদাহ এ উপমহাদেশের তেমনই এক প্রথা।
এদেশে সতীদাহ প্রথা বহুকাল আগ থেকেই প্রচলিত, হিন্দু পুরাণ মতে রাজা দক্ষের কন্যা সতীর স্বামী ছিলেন মহাদেব শিব। কিন্তু রাজা দক্ষ শিবের প্রতি ছিলেন দারুন বীতশ্রদ্ধ। তাই প্রায়শই শিবকে অপমান ও তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতেন রাজা দক্ষ। স্বামীর এ অপমান সইতে না পেরে রাজা দক্ষের কন্যা সতী আগুনে আত্মাহুতি দেন। সেই থেকে স্বামীর প্রতি আনুগত্য ও স্বামী ভক্তির পরকাষ্ঠা প্রদর্শনের জন্য হিন্দুমেয়েদের সহমরণ বা সতীদাহের প্রথা চালু হয়।
প্রাচীন ভারতে এটি খুবই সাধারন ঘটনা ছিল। হিন্দু সমাজ তো বটেই এমনকি সে সমাজের দায়িত্বশীল ব্যাক্তিবর্গও এ কাজকে অতিশয় ভালো কর্ম বলে বিবেচনা করতেন। স্বামীর প্রতি ভক্তি স্বরুপ যে নারী স্বেচ্ছায় চিতায় উঠতেন তাকে বিশেষ মর্যাদা দিতেও ভুলতেন না সে সময়ের মানুষজন৷
তবে অনেক সমাজ বিশ্লেষক ও ইতিহাসবিদরা মনে করতেন বিধবা নারীর সহায় সম্পদ লুট করার জন্য এই রীতি চলমান রেখেছে সেকালের মানুষ। স্বামী মারা যাওয়ার পর তার সম্পদে যেন স্ত্রী বা তার সন্তান কিংবা মেয়ের পরিবার যেন ভাগ বসাতে না পারে তাই এতটা ঘটা করে এসকল আয়োজন চলতো বলে ধারনা অনেকের। অনেক ক্ষেত্রে মেয়ের পরিবারই খুনীর ভুমিকায় অবতীর্ন হতেন৷ বিধবা নারীকে অশুভ ও বোঝা মনে করে তারাই চিতায় তুলে দিতেন অনেক সময়। বাঁচতে চাওয়া মানুষ আগুনের তাপে পুড়ে সেখান থেকে বেরিয়ে আসলে লাঠি দিয়ে বাড়ি মেরে ফের চিতায় পাঠানোরও ঘটনা আছে অনেক।
কিন্তু এদেশে মুসলিম, ইংরেজ অনেক শাসকই চেয়েছিলেন এই বর্বরতা রুখে দিতে। শত শত বছর ধরে চলে আসা এই নৃশংসতম প্রথা মোগল সম্রাট শাহজাহান বিলোপ করতে গিয়েও ব্যর্থ হন। তবে কোনো সদ্য বিধবা নারীর শিশুসন্তান থাকলে তাঁর সতীদাহ করার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলে এমন অনেক সতীদাহের ঘটনা ঘটত, যা সম্রাট বা তাঁর লোকজনের কানে পৌঁছাত না। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ার ভয়ে ইংরেজরাও এই প্রথার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে সাহস পাচ্ছিল না। ফলে সুলতানি আমল এবং বৃটিশ আমলের কিছুদিন পর এ প্রথা বন্ধ হয়
সর্বপ্রথম উইলিয়াম কেরি এ প্রয়াস নেন, তিনি ১৭৯৯ সালে এ নিয়ে লেখালেখি করতে থাকেন তৎকালীন লর্ডকেও তিনি এ বিষয় বন্ধের আবেদন জানান। কিন্তু তিনি সাহস পাননি। এদিকে হিন্দু রাজা রামমোহন রায় এ নিয়ে সোচ্চার হয়ে উঠেন ১৮১২ সাল থেকে। তিনি সমাজপতিদের বোঝাতে শুরু করেন এ বিষয়ে। ১৯২১ সালে এ বিষয়ক একটি পুস্তিকাও প্রকাশ করেন।
এদিকে নতুন লর্ড হিসাবে ১৮২৮ সালে বাংলায় আসেন লর্ড বেন্টিংক তিনি আগ থেকেই এ নিয়ে ওয়াকিফহাল ছিলেন। সবশেষ একটি সাহসী পদক্ষেপ নেন। তিনি ঝুঁকি থাকার পরও ১৯২৯ সালে সতীদাহকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে আইন জারি করেন। কিন্তু তখনো গোঁড়া হিন্দুত্ববাদ এ আইন মানেনি, তারা এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে শুরু করেন। এবং এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন। আপিলে হিন্দুসমাজ বনাম রাজা রামমোহন রায় প্রচুর বিতর্ক হয়। এবং হিন্দু উপনিষদ,বেদ,ঋগ্বেদ, মনুসংহিতা, সহ সকল গ্রন্থ হতে তিনি একে শাস্ত্র বিরোধী বলে প্রমান করতে সক্ষম হন। ফলে আইন বহাল থাকে।
এ বিজয়ের ফলে মুঘল সুলতান রামমোহনকে রাজা ঘোষনা করেন। কিন্তু এতেও থামেনি সতীদাহ প্রথা। সম্ভবত আরেকটি আইন প্রয়োজন ছিল এ বর্বরতাকে সম্পুর্ন মুছে দিতে।
যে সময় এসব ঘটনা চলছিল ঠিক সে সময়ই, অধ্যনরত ছিলেন আরেক সংস্কারক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তিনি কাছ থেকে তার বাল্যসহচরীকে বিধবা হতে দেখেন৷ তিনি দেখতে পান সে মেয়ের নির্মম করুন অবস্থা। যেন বিধবা হওয়াই তার দোষ। আবার আরেকটি মতে, তার এক একাদশী আত্নীয়া অকালেই বিধবা হন। তখন তিনি পরিনত বয়সের একজন মানুষ। তাঁর মা তাকে কাঁদতে কাঁদতে জিগ্যেস করেন, ” তুই এত শাস্ত্র পড়েছিস, এত পড়াশুনা করেছিস, সত্যি করে বল তো শাস্ত্রে কি আসলেই এমন বলা আছে? শাস্ত্র কি এমনই অমানবিক?” এ দুটি ঘটনায় তিনি প্রভাবিত হন এবং
এর পরই নাকি ‘শাস্ত্র-সমুদ্র মন্থন’ করে তিনি লিখলেন ‘বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা’ শীর্ষক প্রবন্ধটি, যা ১৮৫৪-র ফেব্রুয়ারিতে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’-য় প্রকাশিত হয়। ১৮৫৫-র জানুয়ারিতে প্রকাশিত হল তার ‘বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব।’ এর পরই সৃষ্টি হল প্রবল আলোড়ন।
আগেই সতীদাহ প্রথা বাতিল হয়, ফলে একটা জাগরন সৃস্টি হয় হিন্দু সমাজে৷ এই বই প্রকাশের পর সে জাগরণ আরও প্রবল হয়। তৎকালীন বৃটিশ লর্ডরা এর প্রেক্ষিতে ” Hindu re-marriage act 1856 ” পাস করেন। ফলে হিন্দু নারীদের পুনর্বিবাহ বৈধ হয়। সতীদাহ ও বিধবা বিবাহ এ দুটি কু সংস্কার হিন্দু সমাজের নারীদের হত্যার এক সামাজিক ভাবে বৈধ রীতি ছিল। ১৮২৯-১৮৫৬ অবধি প্রায় ৩০ বছরে হিন্দু নারীদের ভাগ্যপট পাল্টে যায় রাতারাতি। যা আরও একটি প্রমাণ যে,শিক্ষাই মুক্তির একমাত্র পথ৷
উল্লেখ্য, আজকের এ দিনেই, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রথম তার ছেলে নারায়ণচন্দ্রের সাথে বিধবা নারীর বিয়ে দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।